আমাদের একক ও অভিন্ন সত্তায় এত ভিন্নতা যা তুলনাতীত; কল্পনাতীত। যদিও বলা হয়, ভিন্নতা বা বৈচিত্র্যই সৌন্দর্য। কিন্তু এই বিচিত্র্তা আমাদের সৌন্দর্য দান করতে পারেনি। বরং এই বিচিত্র্তার কারনে ব্যক্তির সমগ্র সৌন্দর্য হয়ে পরেছে ক্ষয়িষ্ণু। আমরা মুখে মুখে ভূরি ভূরি বাক্য রচনা করি কিন্তু তা কর্মে প্রতিফলন করার তিল পরিমান অধ্যবসায় রাখি না। কর্মে অনেক মনবাধা অতিক্রম করে নামার পর মাঝপথে সব নতসাৎ করে পূর্বের জায়গায় সরূপ নিয়ে ফিরে আসি। আমরা অন্যের সাফল্যকে বাহবা দিয়ে দেখতে চাই না। সফলতার সাথে কালিমা মিশিয়ে গোটা সফলতাকে অসদুপায়ে অর্জিত ফল হিসেবে ধরে নেই। ব্যক্তির মুখমুখি তাকে নমস্কার জানাই, একটু আড়াল হলে তার নামে কুৎসা করিতে দ্বিধান্বীত হই না। আমরা সহজেই কারো মুখরোচক কথায় তার উপর অপার বিশ্বাস স্থাপন করে বসি, তার একটু ভুলে তাকে দুনিয়ার জঘন্য প্রানী ভাবতে কুণ্ঠিত হই না। আর যখনি আমরা অপরের বিশাস ভাঙি তখন নিজকে চতুষ্পদ প্রানি ভাবতে নারাজ। আমরা অকর্মণ্য হলেও সুযোগ পেলেই অন্যকে জ্ঞানগর্ভ কথা শুনিয়ে দেই, কিন্তু নিজে কখনো ঐ কথার মাঝে অবগাহন করি না। কথার মারপ্যাঁচে এমন কিছু অদ্ভুত জ্ঞানের অভূতপূর্ব বিস্তার ঘটাই, যাহা পরক্ষনে উপলব্ধি করিয়া অগ্র-পশ্চাৎ খুঁজিয়া পাই না। অন্যের বিশ্বাস ও ভালবাসা নিয়ে আমরা খেলা করে পরমানন্দ লাভ করি। কিন্তু নিজের বিশ্বাস ভাঙলে আমরা প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠি। শত্রুভাবাপন্ন হইয়া তাহার সর্বস্ব ক্ষতি করিয়া মনোবাসনা পূর্ণ করি। যে কোনো পরিবেশে আমরা যা না, তা প্রকাশ করে বিশেষ সুবিধা নিতে স্বাচ্ছধ্যবোধ করি। কিন্তু যখনি সত্য উন্মোচিত হয়, তখন ঐ সত্যের সাথে ষোল আনা মিথ্যা মিশিয়ে মিথ্যাকেই বলবৎ রাখার আপ্রান চেষ্টা চালাই। সত্য বলার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমরা মিথ্যাকেই মুক্তির উপায় বলে মনে করি। ব্যক্তির আত্নোন্নয়ের জন্য তাকে উপদেশ দেই ঠিকই বটে; কিন্তু সে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক; তা অন্তর থেকে চাই না, অন্তরের অন্তস্থলেই তা আটকে থাকে; বাধান ছিঁড়ে ব্যক্তির মানোন্নয়নের আর্শীবাদ হতে পারে না। আমরা যে কোনো বিষয় কিছুক্ষণ দেখে তার উপর সার্বিক ধারনা পোষণ করি। ব্যক্তির একটি আচরন বা কর্মকে উপজীব্য করে ব্যক্তি সম্পর্কে সামগ্রিক ম্যূলায়ন অব্যাহত রাখি, ক্ষেত্রবিশেষ ব্যক্তি সম্পর্কে আপন ভুল মূল্যায়ন অন্যের নিকট জাহির করে নিজের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণবোধের উদগিরণ ঘটাই। ধর্মের দোহাই দিয়ে আমরা বিভিন্নভাবে পার হয়ে যাই, কিন্তু ধর্ম পালনে অনীহা সীমাহীন। আমরা সজ্ঞানে ধর্মের লেবাস পরিধান করে অন্ধ ধর্মানুভূতি নিয়ে সকল সুযোগ শুষে খেয়ে অসাম্প্রদায়িকতার ট্যাগ লাগিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়াই। অথচ ধর্মের সিকিভাগ জানার চেষ্টা করি না। আবার আমরাই এই অন্ধ ধর্ম জবরদস্তিপ্রবণ মানুষগুলোর ভুল ধর্ম জ্ঞানের সাফাই গাই, তাদের কথায় হ্যাঁ হ্যাঁ করে লালা গ্রন্থির লালার যত্রতত্র নিঃসরণ ঘটাই। আমরা ব্যক্তির পশ্চাৎদে কথা বলি আর সম্মুখে তাকে তোয়াজ করে দিশেহারা হই। ব্যক্তিগত সুবিধা পেতে আপন ব্যক্তিত্ব বিলীন করে অন্যকে এত তোয়াজ করি যেন তিনি উর্ধ্বধলোক থেকে নেমে আসা সর্গীয় দেবদূত। তার সময় অসময়ে বিরতিহীন সঙ্গমের দাবী; আমরা চির অনুগ্রের ন্যায় সদা মেনে নিতে ধরাবাঁধা নিয়ম ছাড়াই বাধ্য থাকি। আমরা অপ্রয়োজনে উচ্চ গলায় খোঁড়া যুক্তির মঞ্চায়ন করে নিজের বুদ্ধি, মগজ ও মস্তিস্কের তীক্ষ্ণতা অনুভব করি। অন্যকে অপমানিত, অপদস্থ ও লাঞ্ছিত করে আমরা আমাদের চৈতন্যকে আনন্দ দ্বারা প্রাচুর্যময় করি। কিন্তু নিজে যখন অপমানিত-অপদস্থ হই, তখন তা হজম করতে যকৃত থেকে পর্যাপ্ত পাচক রস নিঃসৃত হয় না। বরং তা হজমবিহীন কঠিন বস্তুর ন্যায় পাকস্থলীর গাত্রে গাতককে গায়েল করার জন্য আটকে থাকে। অন্যের ভুলকে তাকে আঘাত করার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেই। তারপর তার যে কোনো একটি ভুলে পিছনের সমস্ত ভুলগুলো টেনে এনে শানিত উচ্চারিনে তার শিরায়-উপশিরায় চাবুকের ন্যায় প্রহার করি। আমরা সজ্ঞানে খুব তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে নারীবাদের কথা বলি, কিন্তু নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে চার দেয়ালে আটকে রাখি। বাসার করিডোর থেকে সে বের হলে পাপ আমাদের স্কন্ধে এসে রাহাজানি করবে। আমাদের কলঙ্কিত করবে, সমাজে আপন আত্নসম্মানকে করবে অমর্যাদায় ভূলুণ্ঠিত। কিন্তু আমরা যে প্রকাশ্যে হাজারো পাপের সর্দারি করি, নিত্যনতুন পাপের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে অভ্যন্তরীণ ও ব্যাহিক সৌন্দর্য পঙ্কিল করে তুলি। তা নিয়ে আমাদের বিন্দু মাত্র মাথা ব্যথা নেই। বরং অপরিপক্ব পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিয়ে আপন পাপকে সুঘ্রাণযুক্ত করতে তার উপর জমজমের পানির ছিটে দেই। আর মনে মনে এই ভেবে অর্থহীন প্রশান্তি লাভ করি যে সদ্যপ্রসূত ফুটফুটে নবজাতকের ন্যায় আমি পাপহীন।
আমরা কারো ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অজস্র সময় ব্যয় করি, যখনি ভালোবাসা পেয়ে যাই তখন আমাদের নিকট সময়ের বড় অভাব অনুভূত হয়। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে যে কোনো কার্য হাসিলকে প্রতারণা না ভেবে; কৌশল ভেবে, প্রতারণাকে কাকতাড়ুয়া বানিয়ে দূরে সরিয়ে রাখি। আবার এ কাজে উত্তরোত্তর সাফলতাকে ধর্মীয় রেওয়াজে উদযাপন করে সর্বোপরি মঙ্গল কামনা করি। মূলধন বিনিয়োগ না করে লভ্যাংশ পাওয়ার জন্য এক ধরনের খিরিস্তি বাঁধিয়ে বসি। অর্থের কাছে নিজকে খুব উদ্যমের সহিত বিকিয়ে দেই। অর্থকেই জীবনের সর্বপ্রধান প্রাপ্তি বলে মনে করি। অর্থের কারনেই সম্পর্ক গড়ি আবার অর্থের কারনেই সম্পর্কের যবানিকাপাত ঘটাই। আমরা অন্যের আত্নদানকে পছন্দ করি কিন্তু নিজ আত্না পরার্থে বলিদান দিতে আমাদের অন্তর কুঠরে সাহস সঞ্চারিত হয় না। যুক্তিতে-বুদ্ধিতে পরাস্থ হইলে আমরা আপন মনে কিছু একঘেয়ে বুলি আওড়িয়ে বিজেতা হওয়ার স্বাদকে তিক্ত করি আর গোঁড়ামির বশে ভাবি- শুধু জয়ী হওয়ার স্বাদই পৃথিবীতে শাশ্বত, কল্যাণময় ও সুন্দর। ক্ষেত্রবিশেষ ব্যর্থতাকে মাটি চাপা দিতে বিজয়ীর সম্মুখে অসাধারণ কিছু মানবীয় বাণীর বিস্ফোরণ ঘটাই। আমরা দুধ কলা দিয়ে নিজ শয়ন গৃহে বিষধর সাপ পুষি; যে কিনা কালক্রমে আমাকেই দংশিল। আর যে কিনা দুগ্ধবতী গাভির ন্যায় আমার আমিষ ও পুষ্টিগুনের ব্যবস্থা করল, তাকে আমরা নোংরা গোয়াল ঘরে নির্বাসন দেই।
আমরা বেশিরভাগ বিষয়ই বলার জন্য বলি, করার জন্য করি আর ভাবার জন্য ভাবি। যা আমাদের চরিত্রকে নেহাত দূষিত করে না; বরং আমাদেরকে আমাত্বের কাছে হার মানিয়ে দেয়, দাঁড় করিয়ে দেয় আপন বিবিকের কাঠগড়ায়; যেখানে আমার জন্য কাজ করতে অশুভ শক্তিও অসহায়।
0 comments: