recent

টানা সারে সাত দিন ধরে আরাধনা করছি যে ভারতীয় উপমহাদেশের রন্ধনশিল্পে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারকারী শ্রদ্ধেয় কেকা আপা ; ...

আমি ও কেকা আপা



টানা সারে সাত দিন ধরে আরাধনা করছি যে ভারতীয় উপমহাদেশের রন্ধনশিল্পে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারকারী শ্রদ্ধেয় কেকা আপা; বারবার না আসলেও অন্তত একবার হলেও স্বপ্নলোকে এসে তার নরম হাতের গরম কিছু খাবার যেন আমাকে রেঁধে খাইয়ে যায়।
উমা, সেকি। সে স্বপ্নলোকে আসলই না। কিন্তু সেদিন সে সশরীরে আমার বাসায় এসে উপস্থিত। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। রীতিমতো অবাক। বারবার আপার ভাজ পড়া চামড়াতে চিমটে কেটে দেখছিলাম। আপা ধরনের আচরনে বেশ অসস্তিবোধ করছিল। আর হয়তো মনে মনে ভাবছিল পোলার একটু উনিশ-বিশ কমই।
আমিও আপার এমন স্টেটমেন্টের সাথে সহমত। কারন এমন চিমারাচিমরির অভ্যাস আমার আজকে নতুন না। ছোটবেলা থেকে এই বদভ্যাস আমার সাথে বেড়ে উঠেছে। আমি যখন নার্সারিতে পড়ি, তখন আমার ক্লাশে ইরা নামের একটি মেয়ে পড়ত। তার গালগুলো ছিল কমলা লেবুর মতো। কি জানি কি ভেবে একদিন আমি সেই কমলা লেবুতে একখানা চিমটি বসিয়ে উক্ত লেবুর খোলসসহ বারো আনা মাংশ উঠিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। ততক্ষনে আমার সে কৃত্রিম কান্ড বাতাসে বেড়িয়ে গোটা পাড়ামহল্লা রটে যায়। এদিকে ইরার বাবা তা বাতাসের বরাত দিয়ে শুনতে পায়। তার উপরে তিনি আবার এলাকার বড় নেতা। তাৎক্ষণি সে স্কুল ক্যাম্পাসে এসে হাজির। তারপর কতক্ষন গোটা স্কুল এবং স্কুলের গোটা স্যারদেরকে উপর-নিচ-কাইত-চিত-শুয়াইয়া-বসাইয়া গালিগালাজ করে সারা স্কুল তন্নতন্ন করে খুঁজে আমাকে বের করে; আমার এহেন কাজের জন্য আমার গালে কষিয়ে একখানা চড় বসিয়ে দেয়। তারপর থেকেই আমরা যামির নিচের পাটির দাতগুলো একটু নড়বড়ে। সেই স্মৃতি এখনো আমার দৃশ্যপটে বর্তমান। যাক সেদিকে আর যাচ্ছি না, মূল প্রসংজ্ঞে ফিরে আসি।
তো আমি আমার বিশ্বাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে অনবরত আপার লাঠিম সাইজ শরীরে রক্তচোষা চিমটি দিয়েই যাচ্ছি। এক পর্যায় আপা হঠাৎ ঝাকুনি মেরে বলল, " হুর, ধুর ! সব কিছু লইয়া খেইল (খেলা) থাকলেও চিমটাচিমটি কোনো খেইল না। গেলি এইখান থেইকা।" তারপর থেকে এই মহামায়ার পৃথিবীতে আমি সজ্ঞানে চিমটি থেকে অব্যাহতি নিলাম।
আপা সময়ের ব্যাপারে কোনো কম্প্রোমাইজ করে না। তাই তিনি আমার সাথে অযথাই সঙ্খনাচন না নেচে রান্না ঘরে প্রবেশ করলেন আর তিনি তার মনে মনে ঠিক করা রেসিপির উপকরণ খুঁজে বেড়াতে থাকলেন। ভাগ্যক্রমে পেয়েও গেলেন। তারপর তিনি এমন এক জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলেন যেন অদূরেই একটি পারমানবিক চুল্লি বিস্ফারিত হয়েছে। আমি সেই বিকট চিকারের আওয়াজ সইতে না পেরে দেয়ালের গায়ে হাত বুলিয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। ছাদের রেলিংয়ে মিলন-মধুতে মগ্ন দুটি কাউয়া কা কা করতে উড়ে চলে গেল। তারপর যখন আমার জ্ঞান ফিরল। আপা দেখি রেসিপি নিয়ে আমার সামনে হাজির।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপা, এই রেসিপির নাম কি?
আপা বলল, চুপ থাক আবাল। দেইখা বুঝস না? এইডা হল ঘোড়ার আন্ডা?
আমি বললাম, জ্বী না আপা। আমার সাথে মসকারা কইরেন না! আমার মতো আবাল মানুষ কিন্তু মসকরা একটু কম বুঝে। এইডা ঘোড়ার আন্ডা হইতে যাইব কেন? ঘোড়ার আন্ডা আছে, ঘোড়ার আন্ডার জায়গায়। এইডা হল ভাত। আর ভাতের সাথে কালা কালা কি যেন দেখা যাইতাছে; বুঝতাছি না?
আপা বললেন, তোর মতো আহাম্মুকের বুঝারও কথা না। নালায়েক, রামকান্দা। এমন একটা সুস্বাদু রেসিপি! তুই বুঝস না? এইডা হল "হাগ (শাক) দিয়ে ভাত = হাগাভাত।" অত্যন্ত কঠিন একটি রেসিপি। খুব ডেলিসাস। রান্না করাটাও খুব সোজা। তবে ধাপগুলো নিষ্ঠার সাথে মনে রাখতে হবে। একটু হেরফের হলে উক্ত সুস্বাদু রেসিপি উরফে "হাগাভাত" তার সার্থকতা হারাবে।
আপা কার্টসর্ট রেসিপি সংক্রান্ত বৃফিং দিয়ে আচমকা আমার মুখে এক মুষ্টি হাগাভাত গুঁজে দিল। আমি কিছু না বুঝে উঠার আগেই উক্ত হাগাভাত আমার জিহ্বা তালু গলবিল হয়ে আমার পাকস্থলীতে এসে উপস্থিত। যাওয়ার পথে এমন এক অনুভূতির সঞ্চারণ ঘটাল; যার উদাহরণ খানিকটা এরকম- শীতকালীন মাঘীপূর্ণিমার রাতে ফিটনেসবিহীন বাসের পিছনের সারিতে বসে একটানা একচল্লিশ দিন ধরে জার্নি করলে বৃহদান্ত্র সংযুক্ত পায়ুপথ সংলগ্ন হজমী খাবারও যে পথে ঢুকছে সে পথে বেরুবার বহুদলীয় ইচ্ছাপ্রণোদিত যুগোপযোগী দাবী জানায়; তা অনেকটা সেরকম আপার নিজ হাতে তৈরি হাগাভাত মুখে গুজার পর ঠিক একইরকম অনুভূতি আমার ইহলৌকিক এই জীবনে প্রথমবার অনুভূত হয়েছিল।
আপা ভাষ্যমতে আমি জানতে পারলাম এই সুস্বাদু রেসিপিটি আপা কাউকে শেখান না। নিজ পেটের আপন পোলারেও না। কারন কেউই আপন না। সবাই আপন সাজার ভান করে স্বার্থ হাসিলের পায়তারা করে। নাইলে আপা যে সূর্যদয় থেকে শুরু করে সবে সাদেক পর্যন্ত নিদ্রাতন্দ্রাহীন রাত-দিন রান্নাবান্না শেখায়। কই! কেউ তো একদিন ভদ্রতার খাতিরেও আপার জন্য এক গেলাস সিদ্ধ পানিও নিয়ে আসল না। পৃথিবীতে কেউই নিজ স্বার্থ ছাড়া কাজ করে না। সবাই স্বার্থান্বেষী। আপন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কত কিনা করে। অপরের মঙ্গলের জন্য আড়াশ মিলিগ্রাম লালাও ফেলে না। সেই শর্ত মেনেই আপা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তিনি বনে-জঙ্গলে গিয়ে আর কাউকে রান্নাবান্না শেখাবনে না। কার দায় পড়েছে! এভাবে জনে জনে গিয়ে সবাইকে রান্না শেখানোর। আপা এখন থেকে সর্বত্র খুব নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিবে। তুই রান্নার রেসিপি না জেনে উল্টাপাল্টা খেয়ে মরবি। তাতে আপার কি? তোকে ভালোমন্দ খাবার শেখানোর আপার কেনই বা দায় পড়েছে?
যাইহোক আপার সেই হাগাভাত তাৎক্ষণিক উদগিরণ করে, অপরাহ্নে আপার সাথে শহরের রাস্তায় হাওয়া খেতে বের হলাম। শহরের কোলাহলপূর্ণ রাস্তার নানা অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে আপা আর আমি একান্তে বেশ সময় কাটালাম। এখনো সেই স্মৃতি আমাকে গভীরভাবে আপ্লুত করে। কেননা আপার সাথে একান্ত আলাপচারিতার সুবাধে আমার মনে আপার ব্যাপারে একটি বোধ জন্ম নিয়েছে যে আপা ব্যক্তি মানুষ হিসেবে খুবই সহজ স্বাভাবিক। তাছাড়া তার মানুষের প্রতি আন্তরিকতার কমতি নেই। অত্যান্ত মিশুক শ্রেণীর মানুষ। সহজে রাগে না; গোস্বাও করে না। একেবারে নির্ভেজাল। কিন্তু কেন তাকে অনলাইন ভুবনে জনমানুষের ঠাট্টা-বিদ্রূপ আর রোষানলে পড়তে হয়! তা আমি পঞ্চইন্দ্রীয়ের তীক্ষ্ণতা দিয়েও তখন ঠাওর করতে পারলাম না।
এমন দোদুল্যমান ভাবনা দোলায়িত রেখেই আম আর আপা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হই। রিকশায় আমি আর আপা নিশাচর প্রাণীর মতো নিজদের মাঝে ডুবে আছি। কেউ কোনো কথা বলছি না। হয়তো দুজন দুজনার নিজ নিজ ভুবনে আত্নডুবে মগ্ন ছিলাম। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার আধার কাটল আপার এক হঠাৎ সাহিত সশব্দে। আমি আপাকে কিছু জিজ্ঞেস না করতেই আপা আমাকে বললেন, " আজকে তোকে আমি আমার একটা আনরিলিজড রেসিপি খাওয়াব। তুই খাবি কিনা বল?"
আমি অতিউৎসাহ আর সানান্দে দু'পা লাফিয়ে রাজি হয়ে গেলাম। সাথে সাথে বললাম, " আপা কিসের রেসিপি হবে?"
আপা বললেন, " এই রেসিপিটা একটু আনকমন। তবে এর একটা ফার্স্টক্লাস ফার্স্টক্লাস ভাব আছে। তবে এই রেসিপিটা হচ্ছে একটু ভিন্ন ধারার ফার্স্টক্লাস। অর্থ্যাৎ ফার্স্টক্লাস আর থার্ড ক্লাসের কম্বিনেশন।"
আমি তবুও আপাকে অনুরোধ করে বললাম যে আপা যেন অন্তত দয়া করে রেসিপিটার নামটা একটু বলেন।
আপা একটু আগ্রহ নিয়ে বললেন যে " নামে তেমন বিশেষত্ব নেই। বর্তমান বিশ্বে বৈশ্বিক উষ্ণতা যেমন সবজায়গায় আলোচনার শীর্ষে থাকে কিন্তু কাজের বেলায় সকল ধরনের কর্ম-উচ্চাওয়াজ শিথিল হয়ে পড়ে। আপার এই রেসিপিতে অন্তত সেই ধরনের ডাহা আকর্ষণ নেই। প্রকৃত অর্থে আকর্ষনের পরিচয় মিলবে গুণে।"
তবু আমি আপাকে বললাম, " বলেন না একটু নামটা? আজকাল তো নামেও অনেক কার্য হাসিল হয়!"
আপা বললেন, " তুই তো নাছোড় বান্দা। নাম না শুনে আমাকে ছাড়বি না। তাহলে শোন "কেঁচো দিয়ে হালুয়া = কেঁচোলুয়া।"
আমি নিজকে নিয়ন্ত্রণ করে বললাম, " বেশ সুন্দর।"
ততক্ষনে আপা বললেন, " তোকে কিন্তু আজ রাতের মধ্যেই পৌনে দুই কেজি রিষ্টপুষ্ট কেঁচো মেনেজ করতে হবে। কিরে পারবি না মেনেজ করতে?"
আমি বললাম, " জ্বী জ্বী। অবশ্যই পারমু।"
তারপর থেকে আমি সেই যে আপাকে কেঁচো নিয়ে ফিরে আসার আশা দিয়ে বের হয়েছি, আজও ফিরে যাইনি। সেই মিথ্যা আশা আমাকে আজও পোড়ায়। সেই মিথ্যা আশা আমাকে আজও কাঁদায়। কেননা "কেঁচো দিয়ে হালুয়া = কেঁচোলুয়া" হয়তো পরজীবনে কোনো না কোনোভাবে পেয়ে যেতেও পারি কিন্তু জীবনে তা অধরাই রয়ে গেল।


0 comments: