বঙ্গবন্ধু সেই নিবেদিত প্রাণের নেতা যিনি অভাগা দেশের অকৃতজ্ঞ মানুষের মুক্তির
জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। চাইলে স্বার্থান্বেষীর মতো শত্রু বাহিনীর সাথে আঁতাত করে
জাঁকজমকপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারতেন। সেই প্রস্তাবও এসেছিল, কিন্তু হিমালয়ের মতো শক্তিমান
মুজিব যিনি এদেশের মানুষকে আপন হৃদস্পন্দন ভাবতেন; শুধু তাদের সগৌরবে বেঁচে থাকার স্বার্থে
সেই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যাত করেছেন অবলীলায়।
আপসের পথ অনুসরণ করলে বঙ্গবন্ধুকে কারান্তরালে দিনের পর দিন কাটাতে হতো না, চাইলে তিনি অনায়াসে ক্ষমতার ভাগীদার হতে পারতেন। ১৯৫৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। শেখ মুজিব তখন নবগঠিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সোহরাওয়ার্দী সে দলের প্রধান। মুজিব কারাগার থেকে নেতার মন্ত্রিত্বের খবর পেলেন, মোটেই খুশি হলেন না। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি স্মরণ করেছেন: ‘জেলের ভেতরে বসে আমরা খুবই কষ্ট পেলাম। আমি নিজে কিছুতেই তাঁর আইনমন্ত্রী হওয়া সমর্থন করতে পারলাম না। এমনকি মনে মনে ক্ষেপে গিয়েছিলাম। আমাকে অনুরোধ করেছিলেন শহীদ সাহেব, রোগমুক্ত হয়ে ফিরে এসেছেন দেশে, তাঁকে টেলিগ্রাম করতে। আমি বলে দিলাম, “না, কোন টেলিগ্রাম করব না, আমার প্রয়োজন নাই।”
তবুও তাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে কিছু ছদ্মবেশী স্বাধিনতাপ্রিয় মানুষ প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করার পাঁয়তারা করে। কিন্তু কেন?
এখান থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট, যারা বাংলাদেশকে কখনো একটি স্বাধীন ভূখন্ড হিসেবে দেখতে চায়নি, সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের পরাজিত শক্তিই, স্বদেশ নায়কের সংগ্রামী জীবনকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এই তারাই স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা বিরোধী। স্বাধীনতা রক্ষা করার সংগ্রামে তারাই প্রধান প্রতিদন্দ্বী।
যাকে জীবনের ১২ বছর জেলে কাটাতে হয়েছে। আরো বছর ১২ বছর কাটাতে হয়েছে পুলিশি নজরদারিতে। যিনি তার জীবনের বড় একটি সময় জুড়ে শুধু চিৎকার করে কাটিয়েছেন বাঙালির মুক্তির দাবি তুলে। তিনি আর যাই হোক স্বার্থান্বেষী নয়; বরং স্বার্থত্যাগী। যিনি একটি অবিশ্বাসী জাতির মুক্তির জন্য পারিবারিক আনন্দকে নির্দ্বিধায় অবেহেলা করে, তিনিই আদর্শ, তিনিই শিক্ষক। আমরা যারা তাকে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে ধরে নেই, আসলে তিনি তা নন; মুজিব একজন নিঃস্বার্থ সেবক তথা রাজনীতির উর্ধ্বে।
যে দূরদর্শিতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু বাকশাল কায়েম করেছিলেন, সেই বাকশালকে পুরো উল্টো ভাবে ব্যাখ্যা করে; সেই সময়ের স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এই শক্তির উত্তরসূরিরা এখনো স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক মুজিবীয় শুদ্ধ সত্তায় কালেমা লেপন করতে চায়। যুদ্ধ পরবর্তী তৎকালীন সময়ে মুজিব যখন আহত-জরাজীর্ণ-বিধ্বস্ত দেশ বিনির্মাণ ও দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নিত্য নতুন কর্মপদ্ধতি হাতে নেয়। তখনি স্বাধীনতার সেই অপশক্তি তার বাকশাল নীতির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। সর্বসাধারণের নিকট বাকশলকে ভিন্নভাবে তুলে ধরে। বাংলাদেশকে আলাদা একটি ভূখন্ড হিসেবে দেখতে যারা রাজি ছিল না, সেই তারাই তখন ছন্দের তালে বাকশালের বিরুদ্ধে শ্লোগান রটিয়ে দিল। "এক নেতার এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। " ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা, রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা।"
আসলে মুজিব যে স্বাধীনতা মনেপ্রাণে লালন করেছেন, সে স্বাধীনতা তিনি পাননি। তিনি চেয়েছিলেন বাংলার কৃষক-শ্রমিক-দরিদ্র- নিপীড়িত মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন। কিন্তু স্বাধীনতার পরও সে অবস্থার কোনো উন্নতি সচিত্র দৃশ্যমান হয়নি। অর্থাৎ কৃষক-শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য সম্মানটুকু পায়নি বরং পুঁজিবাদীরাই সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ-দখল করছে। তাই স্বাধীনতা পরবর্তী এক ভাষনে অত্যান্ত ক্ষোভ আর আক্ষেপ নিয়ে বলেছেন, "কাদের টাকায় তুমি জজ সাহেব, কাদের টাকায় তুমি অফিসার সাহেব?
মনে রাখা দরকার, স্বাধীনতা বিরোধী, শ্লোগান নির্মাতা অপশক্তির ভুল ব্যাখ্যা পুঁজি করে একবিংশ শতাব্দীর কিছু মানুষ বিচার-বিবেচনাহীন বহুদলীয় সেই মিথ্যা, যুক্তিহীন তথ্যের প্রচার ও প্রসার এখনো শশব্যস্ত হয়ে করে যাচ্ছে।
আরো মনে রাখা প্রয়োজন, সমাজতন্ত্রী না হয়েও সমগ্র বিশ্ব্যবাপী সমাজতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে স্বাগত জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।” আর বাকশাল কর্মসূচির মূল দর্শন সম্পর্কে বলেছিলেন, “বাকশাল হচ্ছে শোষিতের গণতন্ত্র।” সুতরাং, বঙ্গবন্ধু মুজিব ট্রু ন্যাশনালিস্ট, খাঁটি জাতীয়তাবাদী! যেমনটা সান-ইয়াৎ সেন; কামাল আতাতুর্ক; মহাত্মা গান্ধী; কাওমি নক্রুমা; সালভাদর আলেন্দে; প্যাট্রিস লুমুম্বা, নেলসন ম্যান্ডেলা, রবার্ট মুগাবে প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু মুজিবের সমালোচনা হতে পারে বিস্তর। কিন্তু তিনি কখনোই একনায়ক ছিলেন না; আপাদমস্তক গণতন্ত্রী; গণমানুষের একান্ত আপনজন।
হোসাইন সিয়াম
0 comments: