“দিন থাকিতে দিনের সাধন কেন করলা না।
সময় গেলে সাধন হবে না।”
বিখ্যাত বাউল শিল্পী ও মরমী সাধক লালন সাঁই বহুদিন আগে এক অভাবনীয় দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়ে এমনি একটি গান রচনা করে গিয়েছিলেন। গানের মর্মাথ ছিল- সময়ের কাজটুকু সময়েই করা। অসময়ে; ঐ কাজের পূর্নাজ্ঞ রস শুষিয়া নিলেও কাজের ফলপ্রসূতা গোচরীভূত নয়। কিন্তু বাঙালি সময়ে-অসময়ে গলা ফাটিয়ে এ গানের ঢেঁকুর তোললেও সময়ের কাজটুকু কিন্তু অসিদ্ধই রয়ে যায়।
ইদানিং কিছু ছেলেমেয়েরা আধুনিকায়নের নামে অস্বাস্থকর ও অশ্লীল ফেইসবুকীয় প্রতিযোগিতায় লাগামহীন বেড়ে উঠছে। যেখানে জাপান, ফিলিপাইন ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ছেলেমেয়েরা ইনন্টারন্যাশনাল ম্যাথ, ফিজিক্স ও রোবটিক্স অলম্পিয়াড নিয়ে ব্যস্ত। সেখানে দেশের পরবর্তী শাসন ভার যারা হাতে তুলে নিবে, সেই তরুন সমাজ; হিরো আলম, খান হেলালের ভিডিও নিয়ে মত্ত থাকে। ডিএসএলারে ছবি তোলা নিয়ে মগ্ন থাকে। মার্ক জাকারবার্গের লাইভ বক্তব্যে চিকন পিনের চার্জার খুঁজে, নোয়াখালি বিভাগ চায়। ভাইরাল ভিডিও নিয়ে উন্মাদ থাকে আর অকাল পক্কের পরিচয় দিয়ে আমড়া কাঠের ঢেঁকির ন্যায় কান্ডজ্ঞানহীন কর্মকান্ড অহরহ করে। এই হলো দেশের পরবর্তী কর্ণধারদের নেপথ্যের আকাশ ছোঁয়া কাহিনী।
সম্প্রীতি আবার অনলাইন ও অফলাইনে জন্মদিন উদযাপনের রেওয়াজটা কোনো লিখিত বিধান ছাড়াই রীতিমতো প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তার সাথে সগৌরবে এসে যোগ হয়েছে রুচিহীন, দূর্গন্ধময় ডিম ফাটানো চর্চা। ছেলেমেয়েরা নির্বিশেষে বার্থডে ম্যানের মাথায় ডিম ফাটিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার আটা দিয়ে বার্থডে ম্যানের পুরো মাথা লেপ্টে দিচ্ছে। এভাবে ডিমের মতো পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার নামমাত্র বহুদলীয় আনন্দে নষ্ট হচ্ছে। তা কতই না হতাশাব্যঞ্জক! মুরগীর মতো নিরীহ প্রাণী যদি জানত- মানুষের তরে তাদের এই কষ্টার্জিত সুখাদ্য মানুষ যত্রতত্র নষ্ট করছে এবং কিছু নোংরা মানসিকতার মানুষ তাদের উপহারকৃত দান নিয়ে বিভৎস নোংরামিতে মেতে উঠেছে। তাহলে তারা সাত দফা দিয়ে আমৃত্যু ডিমের মতো পুষ্টিকর খাবার উপহার দেয়া বন্ধ করে দিত। তখন এক নদী অশ্রু ঝারালেও ডিম নামক পুষ্টির আপ্রাপ্তি নিয়েই মানুষকে বেঁচে থাকতে হত।
আমরা যদি একটু সূক্ষ্ন চিন্তা করে দেখি, এই ধরনের বিকৃত রুচিবোধ চর্চা যদি হরহামেশা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় মিশিয়া থাকে। তাহলে নতুন প্রজন্মগুলো নির্দ্বাধায় কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই এহেন চর্চায় সচেতন বা অবচেতন মনে আপাদমস্তক ডুবিয়া রবে এবং প্রজন্ম পরম্পরায় আগামী প্রতিটি প্রজন্ম এই কুরুচিসম্পন্ন নোংরা, কুৎসিত চর্চায় বেড়ে উঠবে। এমনকি এই চর্চাটিকে আরো বেশি অতিরঞ্জিত করে উদযাপনকে আবশ্যক হিসেবে ধরে নিবে। তখন আনাবৃত জিনিসটিকে গরম কাঁথা দিয়ে ঢেকে দিলেও আবৃত করা যাবে না তথা সময় গেলে সাধন হবে না।
আমরা যদি একটু সূক্ষ্ন চিন্তা করে দেখি, এই ধরনের বিকৃত রুচিবোধ চর্চা যদি হরহামেশা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় মিশিয়া থাকে। তাহলে নতুন প্রজন্মগুলো নির্দ্বাধায় কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই এহেন চর্চায় সচেতন বা অবচেতন মনে আপাদমস্তক ডুবিয়া রবে এবং প্রজন্ম পরম্পরায় আগামী প্রতিটি প্রজন্ম এই কুরুচিসম্পন্ন নোংরা, কুৎসিত চর্চায় বেড়ে উঠবে। এমনকি এই চর্চাটিকে আরো বেশি অতিরঞ্জিত করে উদযাপনকে আবশ্যক হিসেবে ধরে নিবে। তখন আনাবৃত জিনিসটিকে গরম কাঁথা দিয়ে ঢেকে দিলেও আবৃত করা যাবে না তথা সময় গেলে সাধন হবে না।
উঠতি তরুণেরা এসব কান্ডজ্ঞানহীন কর্মে পৈশাচিক আনন্দ পেলেও মাঝে মাঝে কিছু ছোট ছোট অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে। ধরা যাক, বার্থডে ম্যানের মাথায় জোর করে ডিম ফাটাতে গিয়ে চোখের ভিতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছে। ধরুন, ডিম দিয়ে এলোমেলো ঢিলাঢেলির করতে গিয়ে চপাত করে কাঁচা ডিম কারো মুখে পড়ে উদরপূর্তি হয়েছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সে ডাইরিয়া নিরাময় কেন্দ্রে গত দুসপ্তাহ যাবৎ ভর্তি রয়েছে। তাছাড়া আবার দেখা যেতে পারে মাথায় সশব্দে ফাটানো ডিমের রস মাথা দিয়ে গড়িয়ে পড়ে খোসাসহ কানে ঢুকে পড়েছে। যাইহোক, এতোটুকু সাইজের ডিমের এই হলো ছোট-বড়-মাঝারি নানা সমস্যা।
ইদানীং আরো একটি চর্চা দেখা যায়। সেটি হলো বিড়ালপ্রীতি, বিড়ালকে কোলে নিয়ে, কাঁধে ঝুলিয়ে, কান টেনে, দুই পা টেনে লম্বা করে ছবি তোলে নিজের টাইমলাইনে ইচ্ছেমতো আপ দেওয়া। তবে তাদের এহেন কাজের পিছনে "জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর" কথাটির তাৎপর্য তারা তাদের হৃদয়ে ধারণ করে কিনা; তা নিয়ে আমি সন্দিহান।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলভেদে কিছু আঞ্চলিক বুলি আছে। যা দীর্ঘদিনের বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে তৈরি। স্থানীয় সালিশে এসব ভাষাগুলো সালিশ কার্যে নিয়োজিত ব্যক্তিগন ব্যবহৃত করে থাকে। এসব বুলিকে স্থানীয় ভাষায় চুটকি বলে। এসব চুটকিসমূহ সালিশ কার্যকে আরো বেশি কার্যকর, যুক্তিযুক্ত ও বেগবান করে। এমনি একটি চুটকি হচ্ছে- "দেশি কুকুরের বিলেতি ডাক"।
এই চুটকির অন্তর্নিহিত কথার একটি উদাহরণ হচ্ছে, প্রত্যেকেরই নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আছে। সে সেই সংস্কৃতিকে বুকে ধারন করে, মনে লালন করে বেড়ে উঠবে পাশাপাশি সে বিদেশি সংস্কৃতি সম্পর্কে শিখবে ও জানবে। তার সাংস্কৃতিক সচেতনতা থাকবে। তবে তার সংস্কৃতির উপর অপসংস্কৃতির আগ্রাসন সে কোনোভাবেই বরদাস্ত করবে না এবং সেও আপন সংস্কৃতিকে দূরে ঢেলে পরসংস্কৃতিকে কাছে টানবে না। কারন যে সংস্কৃতিতে সে পরিপুষ্ট, স্বাস্থ্যবান; সে সংস্কৃতি ভিন্ন অন্য সংস্কৃতি তার সুরে বেমানান। যেমনটা দেখা যায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্য জীবনীতে।
ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে ইউরোপীয় বিড়াল চর্চা আমরা খুব বাধ্যবাধকতা নিয়েই করছি। তা করতে পেরে অনেকে আবার নিজকে আভিজাত্যসম্পন্ন মানুষও ভাবছে। সকালে বিড়ালের আপডেট দিচ্ছে, দুপুরে বিড়ালের গোসলের ভিডিওর সাথে ভাতঘুমের ছবি দিচ্ছে, রাতে বিড়ালের ডায়পারের ছবি তোলে দিচ্ছে। আহা; কি সুখ! লাইলি মজনুর প্রেমের চেয়ে বেশি সুখ।
এই বিড়ালপ্রিয় মানুষগুলোকে কখনো মাতৃত্ব নিয়ে কথা বলতে দেখিনি। শিশু ধর্ষণ, শিশু শ্রম নিয়ে আওয়াজ তোলতে দেখিনি। দেশের অর্থনীতির চাকা সচলকারী, কৃষক-কামার-কুমার-জেলে,তাঁতি ও গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত নিরবে খেটে খাওয়া মানুষদের জীবনের পিছনের গল্প লিখতে দেখিনি। তনুর তরে একটি লাইন লিখতে দেখিনি। তনুর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে দেখিনি। ত্বকী হত্যার বিচার চাইতে দেখিনি। ত্বকীর মেধার সরেস প্রশংসা করতে দেখিনি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি শেখানো দরকার; তা হচ্ছে সেক্স এ্যাডুকেশন। যা আমরা অজ্ঞতার ন্যায় গোপন করে প্রতিটি প্রজন্মের বৃহৎ ক্ষতি সাধন করি, তা নিয়ে তাদেরকে কখনো কলম ধরতে দেখিনি। ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও চরমপন্থিদের নিয়ে কখনো লিখতে দেখিনি। হস্তমৈথুন-ঋতুস্রাব নিয়ে সাহসী লেখার অভিপ্রায় দেখিনি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের অধিকার নিয়ে কখনো কথা বলতে দেখিনি। ধর্মানুভূতিতে অপাঘাত ও সেক্যুলারিজমের বিতর্কিত বিষয় নিয়ে লিখতে দেখিনি। নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন নিয়ে লিখতে দেখিনি। মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে দেখিনি। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে রনাঙ্গনে সশব্দে আওয়াজ তোলতে দেখিনি। কিন্তু
বিড়ালের সোর-রোল সবই; এক ধরনের বাধ্যবাধকতা নিয়ে তাদের আওড়াতে দেখেছি।
যাইহোক লেখার ইতি টানব
অধ্যাপক জাফর ইকবালের
একটি সাধাসিধে উক্তি দিয়ে। ডঃ মোহাম্মদ জাফর ইকবাল মৌলবাদী হামলার শিকার হয়ে সুস্থ হয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়ে হৃদয়ে চাপা ব্যথা ও অভিমান নিয়ে বলেছিলেন:
"কোথায় মানুষ চিন্তা করে চাঁদে যাওয়ার, মঙ্গলে যাওয়ার। আর তোমরা বসে আছ; কে আস্তিক, কে নাস্তিক! এসব নিয়ে?"
0 comments: