বরাবরই বলা হয় মানুষের জীবন অনেক ছোট অনেক সংক্ষিপ্ত। আমার কাছে জীবনটা ঠিক ওরকম না; আমি জীবনকে বৃহৎ পরিসরেই দেখি। কেননা জীবনের সূচনা, জীবনের পথ চলা, জীবনের অন্তিম যাত্রা; ওতোটা সংক্ষিপ্ত না। জীবন, সকল বিচিত্রিতা নিয়ে ধীর গতিতে বহমান একটি নদী।
আমার কাছে জীবনের মানে হল উদযাপন। বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের বাকে বাকে আমি ঘটা করে স্বাদ নিতে উদ্ভদ্ধ একজন মানুষ। আমার কাছে জীবনের মানে প্রতিটি মুহূর্তকে ভালোবাসা, প্রতিটি দিনের সাথে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রেম করা। প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করা সংগ্রামশীল জীবনই আমার কাছে প্রিয়। কারন সংগ্রামী জীবনই সবচেয়ে বেশি 'জীবন উদযাপন' করার সুযোগ পায়। প্রতিকূলতার সাথে সংগ্রাম করে জয়ী হবার মুহুর্তকেই আমার কাছে মনে হয় উদযাপিত জীবনের উৎসব। আমি সেই উৎসবে বিশ্বাসী, সেই উদযাপনে বদ্ধপরিকর একজন মানুষ।
আমি আমার জীবনে আদর্শ ও নৈতিকতা চর্চার বিষয়কে সবচেয়ে বড় করে দেখি। যেখানে সবাই পশ্চাৎপদ ভাবনায় নিমগ্ন, সেখানে আমি এগিয়ে ভাবার প্রানপণ চেষ্টা করি। গতানুগতিক জীবন চর্চা আমাকে কোন কালেই আকৃষ্ট করেনি বরং শিল্প চর্চা আমাকে জীবনে অনন্য স্বাদ মিশ্রিত মধুর সন্ধান দিয়েছে। তাই আমি জাগতিক সকল সৃষ্টি ও স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞ।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার করাকে আমি আমার ধর্ম ভাবি। স্রষ্টা কর্তৃক প্রেরিত ধর্মের মতোই কৃতজ্ঞতা স্বীকার আমার কাছে অবশ্য পালনীয় ধর্ম। কৃতজ্ঞতা স্বীকারকারী ব্যক্তি আমার কাছে খুবই প্রিয়। যার সান্নিধ্য পেতে আমি বরাবরই আকুল হয়ে থাকি। কৃতজ্ঞতা স্বীকার মানুষে মানুষে সম্পর্ককে আরো বেশি দৃঢ় করে, মজবুত করে। আমি এই অমোঘ সত্যেই বিশ্বাসী।
অকৃতজ্ঞ ব্যক্তির সাথে আমার সম্পর্ক থাকলেও কখনো সুসম্পর্ক গড়ার সুচিন্তাও করি না। যতদূর সম্ভব অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। পরিচয়ের কারনে যদি একটু সম্পর্কও থাকে, এই সম্পর্ককে কখনো ধারণ করি না। এ সম্পর্কের জেরে অকৃতজ্ঞ ব্যক্তির উপকার করার একচ্ছত্র অধিকারী হলেও উপকার করি না। স্পষ্ট অর্থে সম্পর্কের যবানিকাপাত ঘটানোর পায়চারি করি।
আমার কাছে তাদেরকে সবচেয়ে নিন্মশ্রেণীর মানুষ মনে হয়, যারা সবার নিকট ভালো সাজার জন্য অন্যের দোষ-ত্রুটি বলে বেড়ায়, অন্যের নামে মিথ্যাচার করে। এ ধরনের মানুষদেরকে আমি কীটপতঙ্গের ন্যায় ক্ষতিকর ভাবি। তাদের ভীরে আমি যাই না, তাদের আড্ডায় আমি শরিক হই না, তাদের মিছিলে আমি শামিল হই না। আমি তাদের হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকি, একাকী থাকি। বন্ধু মহলে এ ধরনের পরনিন্দা চর্চার চেয়ে বিচ্ছিন্ন থেকে অসামাজিকতা ট্যাগ লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো ঢের ভালো। কারন আমি আমাকে ঐ সমাজের প্রতিবেশী মনে করি না। এ ধরনের সমাজের সাথে সম্পর্ক ছেদ ঘটিয়ে অসামাজিকতার চাদর মুড়িয়ে থাকাই আমার কাছে শ্রেয় মনে হয়।
কারো কাছ থেকে কোন কিছু লাভের আশায় চাটুকারিতা করাকে আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অসভ্যতা মনে হয়; অসম্মানেরও বটে। চাটুকারিতা করে অনেকে অনেক কিছু হাসিল করলেও আমি আমার আত্নসম্মান বিসর্জন দিতে নারাজ। যার সম্মানই চলে যায়, তার কি-বা আর থাকে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে চাটুকারিতা করে অর্জিত অর্থ-প্রভাব-প্রতিপত্তি-যশ-সুনাম ইত্যাদির ভিত্তি কি? এ প্রশ্নের সম্মুখীন দেহে এক বন্ধু রক্ত থাকতে হতে চাই না। চাটুকারিতা করা মানে নিজকে অন্যের কাছে বেঁচে দেওয়া, নিজের আত্নসম্মান নিয়ে অন্যের কাছে আত্নসমর্পন করা। যা ইহলৌকিক এ জীবনে আমার দেহের এক তিল জায়গাতে এই ক্ষতের অদৃশ্য স্পর্শ নিতে আমি বড্ড বেশি অনুৎসুক।
আমি ধৈর্যশীল। তবে খুব বেশি নই। ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতা থাকলেও সহ্য করার ক্ষমতা একবারেই নেই। সকল অন্যায়, অত্যাচার ও মিথ্যাচারের সুস্পষ্ট জবাব দেয়ার চেষ্টা করি। যদি না পারি, তবে ছাড় দেই না। সুস্পষ্ট জবাব দেয়ার প্রকৃত সময়ের অপেক্ষা করি৷ প্রকৃত সময় না পেলেও উপযুক্ত সময় খুজে বের করে এর দ্বিগুণ জবাব আপন দেহে অনুরূপিত করে রাখি। আমি সহ্য করার ক্ষমতা দেখিয়ে মহৎ হওয়ায় চেষ্টাকে নিছক বোকামি মনে করি। আমি নিজের সংশ্লিষ্ট বিচার নিজে করতে পছন্দ করি। আমি আপনা বিচারের ক্ষেত্রে মহানুভবতার পরিচয় দেই না।
আমি লজিকাল মানুষদেরকে পছন্দ করি, যারা যুক্তি বুঝে। পাশাপাশি যুক্তির বিরুদ্ধে প্লাটা যুক্তি দাঁড় করাতে পারে; তাদেরকে আরো বেশি পছন্দ করি। যুক্তিনির্ভর, বিশ্লেষণধর্মী কথাই আমার প্রিয়। আমি আবেগীয় কথার চেয়ে জ্ঞান নির্ভর কথা শুনতে পছন্দ করি। আবেগীয় কথাও পছন্দ করি; তবে জ্ঞান নির্ভর কথার তুলনায় নেহাত কম। আমি বিবাধের বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনাকে প্রশংসা করি। তবে অবশ্যই যুক্তি নির্ভর আলোচনা হতে হবে। যুক্তি দিয়ে আমাকে ভুল প্রমানিত করা ব্যক্তিকে আমি সাধুবাদ জানাই, আমার বন্ধুভাবি। অযুক্তিক মানুষের সাথে সম্পর্ক আমার কাছে এক ধরনের বিষাদগ্রস্থতা মনে হয়। যুক্তি, মুক্ত চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করা মানুষের সংস্পর্শে থাকতে পারাকে আমার কাছে আর্শীবাদ মনে হয়।
তাছাড়া এমন শ্রেণীর কিছু মানুষ আছে তারা ধরেই নেয়, তারা যুক্তি মানবে না অথবা তাদের সামনে যুক্তি উপস্থাপন করলেও তারা তাদের আপন গোঁড়ামিতে অনড় থাকবে। এ ধরনের মানুষের সাথে আমি তর্কে যাই না। এ ধরনের মানুষের সাথে তর্কে যাওয়া স্রেফ নির্বুদ্ধিতা ও মূর্খতার পরিচয় বলে মনে করি। তখন তাদের গোঁড়ামিকে মথা ঝাঁকিয়ে শারীরিক সমর্থন দিয়ে আসি। আর মানসিকভাবে নিজেই নিজের আদালতের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে পরিত্যক্ত জবানবন্দি দেই।
আমি আমার সবচেয়ে বড় শক্তি মনে করি- আমার বিবেকবোধ, আমার অনুশোচনাবোধ। আমি মানুষ হিসেবে ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে নই। আমি যথেষ্ট ভুল করি, অন্যায় করি, পাপ করি। তবে আমার বিবেক আমাকে ভাবায়, আমার বিবেক আমাকে সারাক্ষণ তাড়া করে, আমাকে আমার অন্যায় কাজের নির্ভেজাল শাস্তি দেয়। প্রতিটি অন্যায় কাজের গভীর অনুশোচনা আমাকে পরতে পরতে শুদ্ধ করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। আমাকে আমার কৃতকর্মের জন্য নাতজানু করে। আমাকে আমার ভুল বুঝতে পারার পথ বাতলে দেয়। আমাকে কাঁদায়, আমাকে শাসায়। আমার বিবেকবোধ আমাকে লজ্জা দেয়। আমার আপাদমস্তক মূল্যায়ন করে শুদ্ধতার কথা বলে, বিশুদ্ধতার দিকে এগিয়ে দেয়।
আমি যতটুকু উৎসর্গশীল আবার ততটুকুই স্বার্থন্বেষী। আমি যাকে যতটুকু দেই; তার থেকে ঠিক ততটুকুই পাওয়ার আশা করি। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্নতা রয়েছে। আমি নিজের জন্য যেটা পছন্দ করি, অন্যের জন্য ঠিক সেটাই পছন্দ করার চেষ্টা করি। আমি নিজের কাজটুকু রেখে অন্যের কাজটুকু করা যেমন পছন্দ করি না। তেমনি নিজের কাজটুকু অন্যকে দিয়ে করানোও পছন্দ করি না।
বন্ধুত্ব তৈরির ব্যাপারে আমি আন্তরিকতার বিষয়কে প্রাধান্য দেই। যে যত মন্দ স্বভাবের হোক না কেন, তার মাঝে যদি অহংকার না থাকে আর যদি সে অন্তরিক হয়, সবার সাথে মিশে যাওয়ার আপন উজ্জীবনী শক্তি থাকে। তাহলে তাকে আপনজন ভাবতে আমি কখনো মনে সংশয় রাখি না। যমদূতের সামনে দাঁড়িয়েও তাকে বন্ধু ভাবতে দ্বিধান্বিত হই না।
আমি যাকে ভালোবাসি বা অনুসরণ করবার ব্যক্তি মনে করি। তাকে সবসময় একজন পরিপূর্ণ শুদ্ধ মানুষ হিসেবে দেখতে পছন্দ করি। তার একটু ভুল বা তার একটু অশুদ্ধতা আমাকে খুব বেশি বিচলিত করে। কোনভাবেই তার এতটুকু ভুল আমি মেনে নিতে পারি না। কারন তাকে তো আমি ভালোবাসি, তাকে তো আমি অনুসরণ করবার নেতা মনে করি।
অন্যকেউ বা তৃতীয় কোন ব্যক্তি ভুল করলে বা অসুস্থ চিন্তা চেতনা লালন করলে আমি হয়তো তার ভুলটুকু ধরিয়ে দিতে পারি। এর চেয়ে বেশি আর কতটুকুই বা করতে পারি। কিন্তু যে মানুষটি আমার প্রিয়। যাকে অনুকরণ করার প্রবল ইচ্ছা আমার। স্বভাবতই তার ভুলগুলো আমায় রাগান্বিত করে। যে কারনে তার উপর চটে গিয়ে বকুনি দেয়া আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয় না। অসহিষ্ণু হয়ে তাকে আমার মেজাজের চরমাবস্থা জানান দেই।
সময়জ্ঞান সম্পন্ন মানুষদেরকে আমি ভালোবাসি। যদিও আমি ততটা সময়ের খেয়াল রাখি না। তবে সময়জ্ঞান সম্পন্ন মানুষের সহচার্য পাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা অনুভব করি। তাদের শ্বাশত সময় বলয়ে অনুপ্রবেশ করার নিরন্তন ইচ্ছা আমার ভিতর ঝড় বাতাসের ন্যায় সর্বদা বয়ে চলে। মাঝেমাঝে তাদের সময় জ্ঞানের উপর ঈর্ষান্বিত হয়ে হতাশায় মুষড়ে পড়ি। আবার উঠে দাঁড়িয়ে সময় পানে ধাবিত হই। সময়জ্ঞান সম্পন্ন মানুষদেরকে বড্ড সফল মানুষ মনে হয়। যেন অচিরেই তাদের ঝুড়িতে আরো কিছু সফলতা এসে জমা পড়বে। তাইতো সময়ের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে বাঁচবার তীব্র ইচ্ছা দিনকে-দিন তীব্রতর হচ্ছে।
সময়জ্ঞানহীন মানুষ আমার কাছে পীড়াদায়ক মনে হয়। বলা চলে এক ধরনের কান্ডজ্ঞানহীন। আবার এক ধরনের অসুস্থ শ্রেনীর মানুষও মনে হয়। যারা নিজদের অসুস্থ সময়জ্ঞান দিয়ে চারপাশটিকে বিব্রত ও কর্ম বিমুখ করে তোলে। যারা হরদম উদ্দেশ্যহীন জীবন কাটিয়ে দিতে একটুও লজ্জাবোধ করে না। এমন উদ্দেশ্যহীন জীবন আমার কাছে বরাবরই অপ্রিয়।
আমি ছোট-বড় সবাইকে শ্রদ্ধা করতে পছন্দ করি। জোর করে শ্রদ্ধাবোধ আদায় করাকে আমার কাছে কাপুরুষতা মনে হয়। আমি শ্রদ্ধা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে স্নেহশীলতাকে বেছে নিতে পছন্দ করি। কারন আমি মনে করি স্নেহশীল মানুষ বরাবরই শ্রদ্ধা পেয়ে থাকে। আমার কাছে স্নেহশীলতাকে এমন এক অস্ত্র মনে হয়; অর্থ-ক্ষমতা দিয়ে যা অর্জন করা যায় না, স্নেহশীলতা দিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি অর্জন করা যায়।
গোপনীয়তার ক্ষেত্রে আমি একজন পাকাপোক্ত মানুষ। শত্রু কিংবা বন্ধু; আমি সকলের সকল কথা গোপন রাখতে পছন্দ করি। যে কেউ নির্দ্বিধায় যে কোন ধরনের গোপন কথা আমাকে বলতে পারে। আমি নির্মোহভাবে তাকে অভয় দিতে পারি, তার গোপন কথা সূর্যের অপর পিঠের ন্যায় আমার কাছে গোপন থাকবে। কারন গোপনীয়তা আমার কাছে সৌন্দর্যবোধ। আর আমি এই সৌন্দর্য চর্চায় পারদর্শী।
যদি নিজকে এক বাক্যে মঞ্চস্থ করার অভিনয় আসে; তাহলে আমি সবিনয়ে বলব - "আমি মেঘ হতে চাই, শৃঙ্খল মেঘ!"
0 comments: